দেশী মুরগি পালন! মুরগি কিভাবে পালন করে?

দেশী মুরগি পালন! মুরগি কিভাবে পালন করে?

 

আমাদের দেশে এক সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারে মুরগি পালন করতে দেখা যেতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে বর্তমানে সেটি তেমন দেখা যায় না। তবে বর্তমানে বেকারত্ব দূরীকরণসহ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মুরগি পালনকে বেছে নিয়েছেন যুবকরা। মুরগি পালন একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। মুরগি পালনকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে। মুরগি পালন বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক পশুপালন হিসাবে সারা বিশ্বে প্রচলিত।

দেশি মুরগি চেনার উপায়

দেশী মুরগী পালনের আগে দেশী মুরগী চিনতে হবে এবং দেশী মুরগীর বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে জানতে হবে। দেশি মুরগির বৈশিষ্ঠ্য হলো দেশী মুরগীর মাংস এবং ডিম অন্যান্য বিদেশী মুরগীর জাতের তুলনায় বেশি স্বাদযুক্ত ও মজাদার। দেশি মুরগির ডিম অন্য মুরগী ডিম থেকে ছোট। তবুও দেশী মুরগীর ডিম ও মাংশের দাম অনেক বেশি। দেশি মুরগির রোগ বালাইও কম হয়ে থাকে। তাই দেশী মুরগী পালনে তেমন কোন ঝুঁকি ও প্ররিশ্রম নেই। দেশি ‍মুরগীর রোগের বিষয়ে ধারণা থাকলে দেশী মুরগির রোগ বালাই দমন করা যায়।

দেশি মুরগির বৈশিষ্ট্য

দেশি মুরগি মাংস এবং ডিম অন্য জাতের তুলনায় স্বাদযুক্ত এবং বেশি মজাদার বলে দাবি করা হয়। সুতরাং, তাদের কম বৃদ্ধি এবং ছোট আকার সত্ত্বেও, দেশি মুরগী পালন করা ব্যয়বহুল। দেশি মুরগি ১ বছরে ৩০-৪০ টি ডিম দিয়ে থাকে। তাদের ডিম অন্য মুরগি ডিমগুলি থেকে আকারে ছোট। তবুও তাদের ডিম ও মাংশের দাম বেশি। কম টাকা ইনভেস্ট করে বেশি আয় করতে পারবেন। লেখাপড়া বা যে কোন চাকরি করার পাশা পাশি নিজ বাড়িতে গড়ে তুলা যায় এই দেশি মুরগির খামার। দেশি মুরগির রোগ বালাই ও কম। তাই এটি পালনে তেমন কোন ঝুঁকি নেই। কিছু বিষয়ে ধারণা থাকলে সমস্যা বা রোগ বালাই দমন করা যায়।

দেশি মুরগি পালনে সুবিধা

দেশি মুরগী পালনের অন্যতম সুবিধা হলো, এর খাদ্য খরচ কম। স্বল্প বিনিয়োগে বেশি মুনাফা অর্জনে দেশি মুরগি পালন হতে পারে আদর্শ ব্যবসা। সবথেকে আকর্ষনীয় বিষয় হলো, দেশি মুরগির বাজার চাহিদা। সাধারণত ব্রয়লার বা কক মুরগির মত দেশি মুরগির বাজারদর কমে যায়না। সারা বছরই দেশি মুরগির বাজার দর ভালো থাকে। অন্যান্য যেকোনো মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো। ফলে দেশি মুরগির মৃত্যুহার কম। দেশি মুরগি পালনে ঔষধ খরচ তেমন একটা হয়না। তবে লাভজনক খামার গড়ে তুলতে চাইলে বায়োসিকিউরিটি ভালোভাবে মেনে চলতে হবে।

দেশি মুরগির খাবার

দেশি মুরগির খাদ্যাভাস অন্য জাতের মুরগির থেকে আলাদা। তাই এদেরকে যে কোন ধরনের খাবার-ই দেওয়া যায়। যেমন, ভাত, ছোট মাছ, গমের ভুষি, চাউলসহ মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট। তবে যারা খামারে বা আবদ্ধভাবে দেশি মুরগি পালন করেন তারা এই সবুজ খাদ্য মুরগিকে দিতে পারেন এবং কিছু কেনা খাবার দিতে পারেন। কারণ এতে মুরগির বিভিন্ন পুষ্টি পূরণ হয় এবং তারা সুস্থ্য থাকে।

যেভাবে দেশি মুরগি পালন করবেন

আদিকাল থেকে গ্রাম বাংলার মহিলারা বাড়তি আয়ের উৎস হিসাবে মুরগি পালন করে আসছে। মুরগির বিষ্ঠা উন্নতমানের জৈব সার যা ব্যবহার করে কৃষি ফসল উৎপাদনে লাভবান হওয়া যায়। মুরগির বর্জ্য এবং লিটার ব্যবহার করে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব যা ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানী সাশ্রয় করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা যায়।

দেশি মুরগি মূলত দুইভাবে পালন করা যায়। একটি হলো সম্পূর্ণ ছাড়া অবস্থায় এবং আরেকটি হলো আধা ছাড়া বা আধা বদ্ধ অবস্থায়। এই দুটি প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়।

(ক) সনাতন পদ্ধতি।

(খ) উন্নত পদ্ধতি।

সনাতন পদ্ধতি হলো সম্পূর্ণ ছাড়া অবস্থায় দেশি মুরগি পালন। একে সনাতন পদ্ধতি বলার কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতেই দেশি মুরগি পালিত হয়ে আসছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশি মুরগি তার খাবারের প্রায় পুরোটাই নিজে খুঁজে নেয়। এতে করে মুরগিগুলো তাদের মালিকের উপর শুধু বাসস্থানের ব্যাপারে নির্ভরশীল থাকে। অপরদিকে উন্নত পদ্ধতি অর্থাৎ আধা ছাড়া পদ্ধতিতে দেশি মুরগির পালনকারীই মুরগিকে প্রয়োজনীয় খাবারের জোগান দেয় এবং একই সাথে আনুষাঙ্গিক সকল কিছুর খেয়াল রাখে।

আধুনিক পদ্ধতি

আমাদের দেশে খুব কমই আধুনিক পদ্ধতি বা আবদ্ধ অবস্থায় দেশি মুরগি পালন করা হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন বলতে আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালন কে বোঝায়। এই পদ্ধতিতে বেশি পুঁজি লাগে। কিন্তু লাভ ও কম হয়। এই ভাবে দেশি মুরগি পালন করা হয় না। কারণ তাদের কম বৃদ্ধি এবং ছোট আকারের হয়। আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা অনেক ব্যয়বহুল। দেশি মুরগি ১ বছরে ৩০-৪০ টি ডিম দিয়ে থাকে। তাই বেশি লাভ হয় না।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য হাইব্রিড মুরগির চেয়ে অনেক বেশি। ব্রয়লার মুরগি পালনে রোগ বালাই এক ভীষণ আতঙ্কের নাম। কত খামারি যে এর কারণে সর্বস্ব হারিয়েছেন তার হিসাব নেই। কারণ ব্রয়লার মুরগি তেমন রোগ প্রতিরোধী নয়। এছাড়াও ব্রয়লার মুরগির রোগ খুব দ্রুত ছড়ায়। একটি মুরগি অসুস্থ হলেই পুরো খামার অসুস্থ হয়ে যায়। সেদিক দিয়ে দেশি মুরগি অনেক নির্ভরযোগ্য। এরা মাঠে ঘাটে চরে খায় বলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণে বেশি। যদিও তার মানে এই নয় যে দেশি মুরগির একেবারেই রোগ হয় না। কিন্তু দেশি মুরগি পালনে তুলনামূলক ভাবে অনেক নিশ্চিন্তে থাকা যায়।

দেশি মুরগির জাত

মুরগির জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। মনে রাখতে হবে, যেহেতু এই মুরগিগুলো পুরোপুরি খোলা বা অর্ধ-বদ্ধ অবস্থায় পালন করা হবে তাই অবশ্যই এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হওয়া চাই। প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট বাংলাদেশে মুরগির বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ডিম পাড়া দুইটি নতুন জাতের মুরগি স্বর্ণা এবং শুভ্রা, উদ্ভাবন করেছে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের দেশি মুরগির সংখ্যা ২০ কোটির উপরে।

দেশি মুরগির ঘর তৈরি

মুরগির জন্য খোলামেলা ঘর হতে হবে। ১.৫ মিটার (৫ ফুট) লম্বা X ১.২ মিটার (৪ ফুট) চওড়া এবং ১ মিটার (৩.৫ ফুট) উঁচু ঘর তৈরি করতে হবে। ঘরের বেড়া বাঁশের তরজা বা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করতে হবে। এছাড়া মাটির দেয়ালও তৈরি করা যাবে। বেড়া বা দেওয়ালে আলো বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্র থাকতে হবে। ঘরের চাল খড়, টিন বা বাঁশের দরজার সাথে পলিথিন ব্যবহার করে তৈরি করা যাবে। এরকম ঘরে ১০-১৫টি মোরগ মুরগি পালন করা যাবে।

মুরগি পালনের সুবিধা

মুরগি পালন একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা এবং সঠিক ভাবে মুরগি পালন এ ডিম এবং মাংস দুটি সমান হারে পাওয়া যায়। যে কেউ মুরগি পালন বা মুরগি চাষ শুরু করতে পারে। পুঁজি কম হলে হলে বাড়ির ছাদে বা কোন জায়গাতে মুরগি পালন শুরু করা যেতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে বড় আকারে মুরগির চাষ করতে গেলে ডিপ লিটার পদ্ধতিতে মুরগির চাষ করা যেতে পারে।

মুরগি পালনে কম মূলধন থেকে যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করা যায়। প্রাথমিকভাবে মুরগির চাষ করতে গেলে যদি স্বল্প পুঁজি থাকে। তবে স্থানীয় ভিডিও বা সরকারি দপ্তর থেকে অনেক সময় বিনামূল্যে মুরগির ছানা প্রদান করা হয় যেগুলিকে থেকে সহজেই মুরগির চাষ শুরু হয়ে যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সরকারি ও বেসরকারি ভাবেও দেশি মুরগি পালন প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে।

এছাড়াও মুরগির বিষ্ঠা থেকে যত পরিমাণ সার উৎপন্ন হয় যেগুলি কে চাষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনি যদি অন্য পেশায় যুক্ত থাকেন একটি বিকল্প আয়ের এর খোঁজ করে থাকেন তবে আপনার জন্য মুরগি পালন আদর্শ হতে পারে। আপনি এতে অল্প সময় ব্যয় করেও শুরু করতে পারে পারেন।

FAQS-

# দেশি মুরগি পালন কতটা লাভজনক?

=>দেশি মুরগি পালনের ব্যবসা শুরু করা খুবই সহজ। কোন প্রাথমিক মূলধন প্রয়োজন হয় না। বিশেষ করে যদি আপনি একটি শখ বা ট্রায়াল হিসাবে এটি করছেন।

# দেশি মুরগি কি কি খায়?

=>দেশি মুরগিকে সাধারণত ভাত, চাল, গমের ভুষি, ধান খাওয়ানো হয় এতে মুরগি সুস্থ খাকবে ঠিকই কিন্তু ওজন বাড়বে কম। যেহেতু কম সময়ে ওজন বাড়ানো দরকার তাই এই খাবারের পরিবর্তে বাজারে যে সোনালী মুরগির খাবার পাওয়া যায় তা দিতে হবে। এ খাবার মুরগির ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

# পোলট্রি চাষ বলতে কি বোঝায়?

=>বাংলাদেশে পোল্ট্রি চাষ হল বিভিন্ন ধরনের পাখির মাংস, ডিম, পালক উৎপাদন অথবা বিক্রয়ের জন্য গৃহীত প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে পোল্ট্রি বা গৃহপালিত পাখি সবচেয়ে বেশি মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

# মুরগির খাদ্য কত প্রকার?

=>গম, ভুট্টা, ধান, চাল, চালের কুড়াঁ, গমের ভুসি ইত্যাদি। শুঁটকি মাছের গুঁড়া, তিলের খৈল, সরিষার খৈল, সয়াবিন মিল রক্তের গুঁড়া ইত্যাদি। বিভিন্ন উদ্ভিজ তৈল যেমন, পাম তৈল, তিলের তৈল, সয়াবিন তৈল ইত্যাদি। শাকসবজি, ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স ইত্যাদি।

# মুরগি কিভাবে পালন করে?

=>মুরগিকে খাওয়াতে হবে এবং প্রতিদিন জল পরিবর্তন করতে হবে। শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের প্রতিদিন সকালে খাঁচা থেকে বের করে দিতে হবে এবং প্রতি রাতে সন্ধ্যার সময় খাঁচায় রাখতে হবে। স্যানিটেশন এবং গন্ধ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য খাঁচা এবং কলম সাপ্তাহিক পরিষ্কার করা উচিত।

শেষ কথা

সর্বসাধারণের আমিষের চাহিদা পূরণকল্পে দেশি মুরগির চাষ বৃদ্ধি করতে হবে. এতে একদিকে যেমন নিরাপদ মাংস উৎপাদন সম্ভব হবে পাশাপাশি কমবে অতি মাত্রায় পোল্ট্রি মুরগির উপর নির্ভরতা। দেশি মুরগি পালন করলে মুরগির রোগ বালাই ও কম হয় এবং উৎপাদন ও বেশি হয়। দেশি মুরগির বাজার দর সবসময় বেশি থাকায় দেশি মুরগি পালন করে সহজে লাভবান হওয়া যায়।

# কিভাবে ছাগল পালন করতে হয়? ছাগল পালন পদ্ধতি # কিভাবে গরু পালন করতে হয়? আধুনিক পদ্ধতিতে গরু পালন!

Related posts

Leave a Comment